চা শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরীর পাশাপাশি ‘চা শ্রমিক উন্নয়ন কমিশন’ গঠন করা প্রয়োজন : আইপিডি
ঢাকা ২১ আগস্ট ২০২২ :
দেশের চা বাগানসমূহে ন্যায্য মজুরির দাবীতে চা বাগানের শ্রমিকদের আন্দোলনের দাবীকে যৌক্তিক ও ন্যায্য মেনে নিয়ে দৈনিক ন্যূনতম মজুরী ৩০০ টাকার দাবি বাস্তবায়ন করবার আহ্বান জানাচ্ছে ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং এন্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি)।
একইসাথে শ্রমিকদের আন্দোলনের ন্যায্য দাবীকে পুরোপুরি আমলে না নিয়ে দৈনিক ১৪৫ টাকা করবার যে প্রস্তাব সরকার ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাসমূহের পক্ষ থেকে রাখা হয়েছে, সেটি চা বাগানের শ্রমিকদের ন্যূনতম বেঁচে থাকবার অধিকারকে নিশ্চিত করতে পর্যাপ্ত নয় বলে মনে করে আইপিডি।
বিগত দশকগুলোতে চা শিল্পের ক্রমবর্ধমান উন্নতি ও বিকাশ পরিলক্ষিত হলেও চা শ্রমিকদের ভাগ্যের তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি, যা অত্যন্ত বিস্ময়কর ও হতাশাজনক।
প্রজন্ম থেকে প্রজন্মাতরে চা শ্রমিক জনগোষ্ঠী দারিদ্র্য-বঞ্চনা-শোষণের দুষ্টচক্রে আবর্তিত হতে হচ্ছে, বিপরীতে চা শিল্প মালিকদের বিত্ত-বৈভব বাড়ছে ক্রমাগত। যে কোন শিল্প বাঁচিয়ে রাখতে গেলে তার শ্রমিকদের সম্মানজনকভাবে খেয়ে পরে বাঁচবার অধিকার নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
সেটা নিশ্চিত করা না হলে সেই শিল্প, রাষ্ট্রের জন্য সামগ্রিক কল্যাণ বয়ে আনতে অক্ষম, যা শ্রমিকদের জীবনে প্রকারান্তারে অসহনীয় দূর্যোগ বয়ে নিয়ে আসে। সুদীর্ঘকাল ধরে আমাদের চা শ্রমিকরা শুধু কম মজুরিই পাচ্ছেন না – তাদের শিক্ষা, চিকিৎসা, সুষম পুষ্টি, নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন, বাসস্থান, প্রভূত সকল মৌলিক অধিকারসমূহ থেকে তাদের ভীষণভাবে বঞ্চিত করা হচ্ছে। এটা অত্যন্ত স্পষ্ট, দেশের দারিদ্রসীমার সংজ্ঞা (প্রাত্যহিক আয় ও খাদ্য গ্রহণ তথা ক্যালরি ইনটেক) অনুযায়ী চা শ্রমিকেরা দারিদ্রসীমার অনেক নিচে বসবাস করছেন।
চা শ্রমিকদের কল্যাণ নিশ্চিত করা ও জীবনমান উন্নয়নের জন্য চা শিল্প মালিকদের যেমন দায়বদ্ধতা আছে, ঠিক তেমনি এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া ও দিকনির্দেশনা দেবার দায় সরকার এড়াতে পারে না। আমাদের নিকটবর্তী দেশ ভারত ও ইন্দোনেশিয়ার চা শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ৩৫০-৪০০ টাকা এবং ভিয়েতনামে ৩০০-৩৫০ টাকা।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও)’র মতে উপরোক্ত মজুরিভাতাসমূহ স্ব-স্ব দেশের ন্যূনতম ভাতার তুলনায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অনেক কম। ইন্দোনেশিয়ায় ৯৩ ভাগ, ভিয়েতনামে ৪৯ ভাগ এবং ভারতে ৬৬ ভাগ চা শ্রমিক দেশের ন্যূনতম ভাতার তুলনায় কম মজুরি পেয়ে থাকেন।
এই প্রেক্ষাপটে এবং বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির অসহনীয় বাস্তবতায় চা শ্রমিকদের দৈনিক ৩০০ টাকা মজুরির দাবী অত্যন্ত ন্যায্য, মানবিক ও ন্যূনতম জীবন ধারণের মৌলিক মানবাধিকারের দাবি।
দেশের শ্রম আইন, বাংলাদেশের সংবিধান ও আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও)’র সাথে সংগতিপূর্ণ এই দাবী মেনে নিতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণের জন্য শ্রম অধিদপ্তরকে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে জোর দাবি জানাচ্ছে আইপিডি।
আমরা অতীতে শ্রমিকদের বিভিন্ন ন্যায্য দাবী আদায়ের সংগ্রাম থেকে লক্ষ্য করি, আন্দোলন থামানোর জন্য অনেক ধরনের আশ্বাস বাণী এবং ক্ষেত্র বিশেষে আন্দোলনকারী নেতৃত্বের কতিপয় অংশকে বিভিন্নভাবে প্রলুব্ধ করে আন্দোলনের গতিপ্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়; কিন্তু শ্রমিকদের ন্যায্য ও মানবিক দাবীগুলো আর পূরণ করা হয়না।
এক্ষেত্রে মালিকদের স্বার্থ রক্ষা করতে সরকারী সংস্থাগুলো অধিক আগ্রহ দেখায়, এ ধরনের অভিযোগও রয়েছে। আইপিডি আন্তরিকভাবে মনে করে, চা শ্রমিকদের আন্দোলনকে ন্যায্য বিবেচনা করে সরকার তাদের ন্যূনতম মজুরীর দাবি মেনে নিয়ে তাদের মানুষ হিসেবে মর্যাদাপূর্ণ জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে চা শিল্প মালিক, শ্রম অধিদপ্তর, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে যথাযথ নির্দেশনা প্রদান করবে। একইসাথে চা শ্রমিকদের জীবনমানের যথাযথ উন্নয়ন নিশ্চিত করতে দেশের শ্রম আইন ও আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও)’র নীতিমালা সমূহ বাস্তবায়ন করতে সরকার ও রাষ্ট্র যথাযথ সচেষ্ট হবে।
ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং এন্ড ডেভেলপমেন্ট মনে করে চা শ্রমিকদের উন্নয়নের মূল স্রোতধারায় নিয়ে আসবার জন্য অতি জরুরি ভিত্তিতে ‘চা শ্রমিক উন্নয়ন কমিশন’ গঠন করা প্রয়োজন।
উক্ত কমিশন চা শ্রমিকদের মজুরীসহ মৌলিক নাগরিক সুবিধাদি যথাঃ শিক্ষা, চিকিৎসা, সুষম পুষ্টি, নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন, বাসস্থান, প্রভূত সকল মৌলিক অধিকারসমূহ নিশ্চিত সরকারকে প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা প্রদান করবেন।
আইপিডি মনে করে, স্বাধীনতার অর্ধশত বছর পরে চা শিল্প সংশ্লিষ্ট দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে সুবিধাবঞ্চিত ও পশ্চাদপদ রেখে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জন করা সম্ভব নয়। এ ব্যাপারে চা শিল্প মালিক সহ সংশ্লিষ্ট সকলের যথাযথ করণীয়সমূহ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করে চা শ্রমিক জনগোষ্ঠীর কল্যাণ নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রকেই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে।