পরিবেশ সুরক্ষায় ১০ দফা সুপারিশ চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের
ঢাকা ০৫ জুন ২০২২ :
পরিবেশ দুষণ ও সুরক্ষা বিষয়ক জাতীয় তারুণ্য জরিপ ২০২২ এ বছরে পরিবেশ দূষনজনিত অসুস্থতায় ব্যায় ৩৪ বিলিয়ন ৩৮ কোটি টাকা এবং ১৫-৩৫ বছরের প্রতি তরুণ গড়ে প্রতিদিন একটি প্লাষ্টিক ব্যাগ তথা বছরে প্রায় ১৯ বিলিয়ন প্লাষ্টিক ব্যাগ ব্যাবহারের কথা জানিয়েছেন।
জরিপে তরুণরা তার এলাকায় একের অধিক দূষণের কথা বললেও ৩৫.৯৫% তরুণ মনে করে বাংলাদেশের বায়ু দুষণের প্রকোপ সবচেয়ে বেশি, তরুণদের মতে পানি ও শব্দ দূষণের মাত্রা বলেছে যথাক্রমে ২৬.৮৪% ও ২৭%। প্রধান নগরী ঢাকা বায়ু দূষণের ফলে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে (৩৭.৭০%)।
৪ জুন চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভ এর প্রধান কার্যালয়ে “পরিবেশ দূষণ ও সুরক্ষা বিষয়ক তারুণ্য জরিপ ২০২২” এর ফলাফল সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে প্রকাশ করার মধ্য দিয়ে।
দ্বিতীয় ভাগের অনুষ্ঠানের বিশেষজ্ঞ মতামত রেখেছেন, ড: মোস্তাফিজুর রহমান, সহযোগি অধ্যাপক, পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। জরিপটির ফলাফল উপস্থাপন করেছেন মো. খোরশেদ আলম, কর্মসূচি সমন্বয়কারী, চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভ। এছড়াও ৭টি সমমনা সংগঠনের পক্ষ থেকে লাল সবুজ সোসাইটি’র সমন্বয়ক আহমাদুল্লাহ পরাগ বক্তব্য তুলে ধরেছেন। অনুষ্ঠান সুচীর শুরুতেই স্বাগত বক্তব্য রাখে চেঞ্জ ইনিটিয়েটিভের প্রধান নির্বাহি, এম জাকির হোসেন খান প্রকৃতি ও পরিবেশ সুরক্ষায় নীতি ও আইনের পাশাপাশি তরুণদের নেতৃত্বে সমন্নিত উদ্যোগ গ্রহণের কথা বলেন। তিনি মনে করেন, পরিবেশ সুরক্ষায় সবুজ উদ্যোক্তা তৈরির বিকল্প নাই।
জরিপের ফলাফল তুলে ধরে মো. খোরশেদ আলম বলেন, সামগ্রিকভাবে জরিপে অংশ নেয়া ১০২৩ অংশগ্রহণকারী তরুণ তাদের প্রত্যেকের এলাকায় একের অধিক দূষণের কথা বলার পাশাপাশি ৩২.৮% উত্তরদাতা মনে করছেন তাদের পরিবার বায়ু দূষনের ফলে মারাত্মক ঝুকিতে রয়েছেন। গবেষণার ফলাফলে বলা হয়, বায়ু দূষণের প্রধান উৎস হলো মেরামতহীন ভাঙাচোড়া রাস্তাঘাট (১৮.৭১%), ফিটনেসবিহীন যানবাহনের কালো ধোয়া (১৯%) রাস্তাঘাট ভবনসহ নির্মাণ ও সংস্কার কার্যক্রম (১৫%) এব গৃহস্থালীর বর্জ্য (১৩.৭%)। ৬৪% তরুণ দাবি করছে যে বায়ু দূষণের ফলে তার এলাকায় প্রায়ই মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ছে। পক্ষান্তরে ৪৩% তরুণ মনে করে বায়ু দূষণ মোকাবেলায় সরকারের পক্ষ থেকে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নেই। মাত্র ২% তরুণ মনে করে পানি দূষন নিয়ে সরকারের কঠোর পদক্ষেপ দৃশ্যমান।
জরিপকৃত প্রতি ৪ জনের ১ জন তরুণ কলকারখানা থেকে নির্গত বর্জ্য নদী দূষনের প্রধান কারণ বলে মনে করেন। প্রায় ৫০% তরুণ প্লাষ্টিকের দূষণের প্রভাবে জলাবদ্ধতা এবং জলাধারে নাব্যতা সংকটের কথা বলেছেন। প্রায় ৬১% তরুণ তার এলাকায় সাইকেল লেন না থাকার কথা বলেছেন। পরিবেশ দূষনজনিত অসুস্থায় গড়ে ১৭ দিন কর্মহীন কাটাতে হয়েছে এবং চিকিৎসা বাবদ গড়ে প্রায় ১০,৫৮৭ টাকা ব্যায় হয়েছে। বছরে দুষণ জনিত অসুস্থতায় ব্যয় হচ্ছে ৩৪.৩৮ বিলিয়ন টাকা। নিয়ন্ত্রণহীন পরিবেশ দূষণের প্রায় ২ এর অধিক কারণের কথা বললেও প্রধান কারণ হিসাবে নাগরিক সচেতনতার ঘাটতি, আইনের যথাযথ প্রয়োগ না থাকা এবং প্রয়োজনীয় আইন কাঠামোর অনুপস্থিতি, স্থানীয় সরকারের নিষ্ক্রিয়তার কথা বলেছেন।
বায়ু এবং পানি দূষনের মূল কারন হিসাবে সব থেকে বেশি যথাক্রমে ইঞ্জিন চালিত বাহন থেকে নির্গত কালো ধোঁয়া (১৯.২%) এবং গৃহস্থালী বর্জ্যকে (১৯.৮%) চিহ্নিত করেছে। প্লাস্টিক বর্জ্য অব্যবস্থাপনার কারণে বাংলাদেশ প্লাস্টিক দূষিত দেশগুলোর একটি। বিশ্বব্যাংকের প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলছে, গত ১৫ বছরে বাংলাদেশের শহরাঞ্চলে মাথাপিছু প্লাস্টিক ব্যবহারের হার ২০০৫ সালে ৩.০ কেজি থেকে ২০২০ সালে তিনগুণ বেড়ে ৯.০ কেজি হয়েছে। আমাদের জরিপের পরিসংখ্য্না বলছে প্রত্যেক তরুণ গড়ে প্রতিদিন অন্তত একটি পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করে এবং দেশে ১৫-৩০ বছর বয়সি তরুণের ব্যবহৃত বাৎসরিক পলিথিন ব্যগের সংখ্যা ১,৮৭০ কোটি পিস। ৬১ শতাংশ তরুণ মনে করেন দেশে সাইকেল চালানোর জন্য উপযোগী রাস্তা বা লেন রয়েছে এবং ৬৪ শতাংশ তরুণ প্রতিটি এলাকায় বাই সাইকেল চালানোর লেনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছে।
ড: মোস্তাফিজুর রহমান, সহযোগি অধ্যাপক, পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, তার বক্তব্যে তুলে ধরেন, যে বর্তমানে আমরা পরিবেশগত নানাবিধ সমস্যা মোকাবেলায় আমরা সংকটপূর্ন সময় অতিবাহিত করছি এবং বর্তমানে এন্থ্রপসিয়ান যুগে প্রবেশ করছি। এর কারনস্বরূপ আমরা নিজস্ব প্রয়োজনে প্রবেশকে যেভাবে ব্যবহার করছি তাতে আমরা আমাদের সামাজিক টেকসই অবকাঠামোকে ব্যহত করছি। তিনি বায়ুদূষণকে প্রধান দূষণ হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন কারন আমরা দৈনিক যে পরিমান পানি সেবন করে থাকি তার থেকে অনেক গুন বেশি আমরা প্রকৃতি থেকে বায়ু গ্রহন করে থাকি।
তিনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে বাইসাইকেলের ব্যবহারকে উৎসাহিত করেছেন। তিনি উল্লেখ করেন বাংলাদেশে যে প্রচলিত বর্জ্যরে ভাগাড় রয়েছে তা মোটেই কোনো প্রস্তাবিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নয়। তিনি আর উল্লেখ করেন যে, বাংলাদেশে স্যানিটারি বর্জ্যরে ভাগাড় এবং পয় বর্জ্য বা সুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্লান্ট নাই, যা দেশের পানির স্বাস্থ্যকে ব্যপক আকারে সংকটাপন্ন করছে।
২০২৫ এর মধ্যে প্লাস্টিক-মুক্ত বাংলাদেশ, সকল নগর ও শহরে সাইকেলের পৃথক লেনের পাশাপাশি ২০৩০ এর মধ্যে শূন্য কার্বন নিঃসরণ, শূন্য বায়ু, পানি ও শব্দ দূষণ এবং শতভাগ নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের ব্যবহার নিশ্চিতে ১০ দফা সুপারিশ প্রণয়ন করেছে।
স্বল্প ও মধ্যমেয়াদে প্রধান সুপারিশগুলো হলো:
১) প্রকৃতি ও পরিবেশের সুরক্ষা ও সংরক্ষণের পাশাপাশি সব ধরনের দূষণ (বায়ু, পানি, মাটি, শব্দ) ও দখল রোধে বাংলাদেশের সাংবিধানিক (১৮ ক অনুচ্ছেদ) বাধ্যবাধকতা ও আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন নিশ্চিতে ক) সমন্বিত পরিবেশ ও প্রতিবেশ আইন ও বিধি প্রণয়ন; এবং খ) আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের সাথে সামঞ্জস্য রেখে যেকোনো ধরনের প্রতিবেশ ও প্রকৃতি ধ্বংশকে ‘প্রকৃতির বিরুদ্ধে অপরাধ’ বলে আইনী সংস্কার;
২) পরিবেশ, প্রতিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মামলার দ্রুত নিস্পত্তিতে অভিজ্ঞ ও প্রতিশ্রুতিশীল আইনজ্ঞের সমন্বয়ে বিশেষায়িত ‘সবুজ আদালত’ প্রতিষ্ঠা;
৩) প্লাষ্টিক সহ সব ধরনের বর্জ্য সংগ্রহ এবং এর পুনঃচক্রায়নে তরুণ উদ্যোক্তা সৃষ্টিতে কার্যকর কর ও সহনীয় শর্তে বিনিয়োগ সুবিধা প্রদান;
৪) বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সহ নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনে পরিবেশ সুরক্ষায় বেসরকারি বা ব্যক্তি খাতের অংশগ্রহণ নিশ্চিতে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান যাতে পিপিপি মডেল যথাযথভাবে প্রয়োগ করতে পারে সেজন্য কার্যকর আইনী ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো প্রণয়ন;
৫) সব ধরনের দুষণ ও মাত্রাতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণ রোধে প্রযুক্তিভিত্তিক দূষণ পরিমাপ পদ্ধতির ভিত্তিতে দৃষ্টান্তমূলত আর্থিক ‘দূষণ ও কার্বন কর’ চালু এবং তার প্রয়োগে স্বচ্ছতা নিশ্চিতে তথ্যের সর্বোচ্চ উন্মুক্তকরণ;
৬) বিদ্যমান আইনের প্রয়োগ নিশ্চিতে পরিবেশ সুরক্ষা ও সংরক্ষণের সাথে সম্পৃক্ত প্রতিটি সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান/সংস্থা ও সংশ্লিষ্ট কর্মী/দায়িত্বশীল ব্যক্তিকে আইসিটি-ভিত্তিক অটোমেটেড ও সময়াবদ্ধ কার্যক্রম প্রণয়ন ও তার কঠোর বাস্তবায়নে জবাবদিহিতা নিশ্চিতে ‘পুরস্কার ও তিরস্কার’ ব্যবস্থা চালু ;
৭) বৈশ্বিক জ্বালানি সংকট ঘনীভূত হওয়ার প্রেক্ষিতে জ্বালানি নিরাপত্তা ও টেকসই অগ্রযাত্রা নিশ্চিতে সম্পূর্ণ দেশীয়ভাবে উৎপাদিত নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের ব্যাবহার নিশ্চিত করা;
৮) নদী কমিশনের চিহ্নিত পানির উৎস দখল ও দুষণকারীদের বিরুদ্ধে আইনী পদক্ষেপের পাশাপাশি সব ধরনের সরকারি সুবিধা প্রাপ্তির অযোগ্য বলে ঘোষণা;
৯) প্রতি নগর এবং শহরে বায়ু দূষণ রোধে ইলেকট্রিক এবং সৌরচালিত কলকারখানা, যানবাহন, ইলেকট্রনিকস পণ্য এর ব্যাবহারে সব ধরনের কর রেয়াত ও এ খাতে স্বল্প/বিনা সুদে বিনিয়োগ সুবিধা প্রদানে আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে এবং এনজিওকে এগিয়ে আসা; এবং
১০) সবুজ উদ্যোক্তাদের প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ সংগ্রহে বিনা সুদে জামানতবিহীন দীর্ঘমেয়াদে কিস্তির সুবিধাসহ মূলধন প্রদানে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিৎ।
এর আগে ৪ জুন সকাল ৮ টায়, দূষণ রোধে যুব সমাজের উদ্ভাবনী চিন্তা, সক্রিয় অংশগ্রহণ ও টেকসই উদ্যোগ গ্রহণে তরুণ সমাজের অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধিকে বিশ্লেষণের লক্ষ্যে চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভ এর উদ্যোগে ও ৭টি সমমনা সংগঠনের সহযোগিতায় দুটি গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। পরিবেশ দিবসকে সামনে রেখে চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভ এই কার্যক্রম দুটি আয়োজন করেছে যা দিনের দুই ভাগে পর্যালোচনা করা হয়েছে।
দিনের প্রথম ভাগে, সকাল ৭.৩০ মিনিটে মানিক মিয়া এভিনিউ এ তারুণ্য সমাবেশ ও বাইসাইকেল র্যালির আয়োজন করা হয়েছে। ঢঅনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) এর সাধারণ সম্পাদক শরিফ জামিল, শিক্ষক সৈয়দা রতœা, ইনস্টিটিউট অব ওয়েলবীইং বাংলাদেশের পলিসি অফিসার আ ন ম মাছুম বিল্লাহ ভুইয়া ও চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভ এর নির্বাহী পরিচালক এম জাকির হোসেন খান।