বাসযোগ্য ঢাকা গড়তে বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা’র যথাযথ বাস্তবায়ন প্রয়োজন : আইপিডি
ঢাকা ২৪ আগস্ট ২০২২ :
ঢাকা মহানগরীর টেকসই নগরায়ন নিশ্চিত করতে ও বাসযোগ্য ঢাকা গড়বার মূল পরিকল্পনা দলিল হিসেবে বহুল প্রতীক্ষিত ঢাকার বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ ২০১৬-৩৫) অনুমোদন করায় সরকারকে সাধুবাদ জানাচ্ছে ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং এন্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি)।
একইসাথে ঢাকা শহরের মত অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং এই শহরের পরিকল্পনা প্রণয়নের সাথে যুক্ত রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় সহ বিশদ অঞ্চল্প পরিকল্পনা প্রণয়ন সংশ্লিষ্ট সকলকে ধন্যবাদ জানাচ্ছে (আইপিডি)।
২০১০ সালে প্রণীত পূর্ববর্তী ড্যাপের নির্ধারিত মেয়াদ ২০১৫ সালে পার হবার কারণে ঢাকা শহরের পরিবর্তিত নগর বাস্তবতায় নতুন বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা প্রণয়ন করা জরুরি হয়ে পড়েছিল।
কিছুটা বিলম্বে হলেও ঢাকা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের জন্য অনুমোদিত এই বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা সঠিক ভাবে প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন করা হলে, ঢাকার নগরায়ন এবং নগর উন্নয়ন পরিকল্পনাকে সঠিক গতিপথে চালিত হতে পারে বলে আইপিডি মনে করে।
একই সাথে আইপিডি বিশ্বাস করে, যে কোন পরিকল্পনা দলিলে অনুসৃত পরিকল্পনা কৌশল, পন্থা ও দিকনির্দেশনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
অনুরূপভাবে পরিকল্পনার সফলতা কিংবা ব্যর্থতা নির্ভর করে পরিকল্পনা বাস্তবায়নে রাষ্ট্র ও সরকারের সংশ্লিষ্ট সকলের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে আন্তরিক সদিচ্ছা, যথাযথ প্রয়োগ, প্রয়োজনীয় অর্থায়ন, উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ, আইনের শাসন ও জনস্বার্থ-জনকল্যাণ রক্ষায় পরিকল্পনা ও নীতি-নির্দেশনার নির্মোহ ও যথাযথ বাস্তবায়ন এর উপর।
অতীতে ঢাকা মহানগরীর জন্য প্রণীত কাঠামোগত পরিকল্পনা, মহাপরিকল্পনা কিংবা বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা দলিলগুলো সঠিক ও পূর্ণ বাস্তবায়নের অভাবেই ঢাকা ক্রমান্বয়ে বাসযোগ্যতা হারিয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করেই অনুমোদনহীন শিল্প-কারখানা কিংবা ভবন নির্মাণ হয়েছে কিংবা ভূমি ব্যবহার নির্দেশনার ব্যত্যয় ঘটিয়ে জলাধার-বন্যা প্রবাহ অঞ্চল ভরাট করা হয়েছে। ফলে ঢাকার বাসযোগ্যতা কমেছে মারাত্মকভাবে এবং ঢাকা ক্রমশ বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে।
এবারের বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায় আধুনিক নগর–পরিকল্পনার বেশ কিছু কৌশল প্রয়োগ করা হয়েছে। এর মধ্যে ব্লক ডেভেলপমেন্ট, কমিউনিটিভিত্তিক উন্নয়ন পরিকল্পনা ও সেবার বিকেন্দ্রীকরণ, মেট্রো স্টেশনভিত্তিক ট্রানজিট ওরিয়েন্টেড ডেভেলপমেন্ট (টিওডি), জনঘনত্ব জোনিং, ট্রান্সফার অব ডেভেলপমেন্ট রাইট (টিডিআর), ওয়ার্ডভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবা এবং মানসম্পন্ন সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিনোদনকেন্দ্র সৃষ্টি ইত্যাদি বিষয়ের পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন শহরের মানুষের জীবনযাত্রাকে সহজ করবে। পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় আঞ্চলিক পার্ক, জলকেন্দ্রিক পার্ক, ইকোপার্ক তৈরি, পথচারীবান্ধব অবকাঠামো তৈরি ও বাইসাইকেল লেনকে উৎসাহিত করা এবং অযান্ত্রিক পরিবহনকে সামগ্রিক পরিকল্পনার সঙ্গে সমন্বয় করা—এসব বিষয় ড্যাপে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে।
অপরিকল্পিত এলাকাকে পরিকল্পনামাফিক উন্নয়নের জন্য সহায়ক কৌশল হিসেবে ভূমি পুনর্বিন্যাস ও ভূমি পুনঃ উন্নয়নের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এই পরিকল্পনায় অন্তর্ভূক্ত হয়েছে । ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ২০০৬ সালে প্রণীত হবার সময় এলাকাভিত্তিক ফ্লোর এরিয়া রেশিও (এফএআর) প্রণয়ন করবার কথা বলা হয়েছিল, যা এবারের ড্যাপে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে।
আইপিডি মনে করে, এলাকাভিত্তিক ‘এফএআর’ এর সঠিক প্রয়োগের মাধ্যমে জনঘনত্ব ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি ভবন ও কমিউনিটিতে আলো-বাতাসের প্রবেশগম্যতার পাশাপাশি নগরের উষ্ণায়ন রোধে সহায়ক হবে। আবার নগর পরিকল্পনা একটি পরিবর্তনশীল প্রক্রিয়া হওয়াতে সামনের দিনগুলোতে ড্যাপ বাস্তবায়নে পর্যায়ে প্রাপ্ত অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা’কে নির্দিষ্ট সময় পরপর পূনঃমূল্যায়ন করে এই পরিকল্পনাকে আরো সমৃদ্ধ করা হবে বলে আইপিডি আশা করে।
বাস্তবিক অর্থে ড্যাপে প্রস্তাবিত সকল পরিকল্পনা কৌশলের সফলতা নির্ভর করবে তার যথাযথ প্রয়োগ ও বাস্তবায়নের উপর। এজন্য ঢাকা মহানগর এলাকায় কার্যরত স্থানীয় সরকারসমূহ যথাঃ সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ প্রভৃতি সংস্থাসমূহকে বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা অনুযায়ী এলাকাভিত্তিক উন্নয়ন পরিকল্পনা দ্রুত প্রণয়ন করবার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। প্রকৃত অর্থে নগর উন্নয়ন পরিকল্পনার সফল বাস্তবায়নের সাথে রাষ্ট্রের বিভিন্ন সংস্থাসমূহের আন্তরিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে এই পরিকল্পনা দলিলের যথাযথ অনুসরণ করবার ক্ষেত্র তৈরি করাটা প্রয়োজন। পাশাপাশি এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থায়ন পরিকল্পনা ও কার্য পরিকল্পনাসমূহ প্রণয়ন করবার উদ্যোগ এখনই নিতে হবে।
একইসাথে আইপিডি মনে করে, বেসরকারি শিল্প উদ্যোক্তা, ভবন নির্মাতা ও আবাসন ব্যবসায়ী, ব্যবসা-বাণিজ্য সংশ্লিষ্ট মহলসহ জনসাধারণ ও নাগরিকদের এই পরিকল্পনাকে অনুসরণ করে সকল ধরনের উন্নয়ন কার্যক্রম করবার আন্তরিক আগ্রহ থাকলে সরকারের পক্ষে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা সহজতর হবে ।
খসড়া ড্যাপের গণশুনানিতে দেখা গিয়েছে পরিকল্পনার বিভিন্ন বিষয়ে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের পরিকল্পনার কৌশল ও পন্থা নিয়ে মতভিন্নতা ছিল। এবারের ড্যাপে নিয়ন্ত্রিত মিশ্র ব্যবহার, ভূমি ব্যবস্থাপনা, বন্যা প্রবাহ ও কৃষিভূমি সংরক্ষণ, ভূমি উন্নয়ন স্বত্ব প্রতিস্থাপন’সহ অনেক কৌশল মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে পেশাগত ও পরিকল্পনাগত জ্ঞানের চর্চা ও প্রায়োগিক অনুশীলন করবার প্রয়োজন হবে অতীতের চেয়ে অনেক বেশি।
এক্ষেত্রে নগরের বৃহত্তর কল্যাণ ও জনস্বার্থ নিশ্চিত করতে রাজউকের নগর পরিকল্পনা শাখাকে শক্তিশালী করে তোলতে হবে এবং রাজউক’কে পেশাজীবি সংস্থা হিসেবে গড়ে তোলতে হবে। ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং এন্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি) আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করে, রাষ্ট্র ও সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও প্রত্যয় এবং প্রায়োগিক ক্ষেত্রে অনমনীয় দৃঢ়তা থাকলে এই পরিকল্পনার যথাযথ বাস্তবায়ন করবার মাধ্যমে ঢাকাকে বাসযোগ্য করে তোলা সম্ভব হবে।